আগের পোস্টের ধারাবাহিকতায় এ অংশে ফ্রীলান্স সম্পর্কিত অন্যান্য বিষয়াদি পাঠকদের জন্য বিবৃত করা হলো । আশা করছি আমার পাঠকগণ উপকৃত হবেন । তাহলে শুরু করা যাক -----
ফ্রিল্যান্স আউটসোর্সিং-এর আদ্যোপান্ত (শেষাংশ)
ওডেস্ক
(www.oDesk.com)বৈশিষ্ট্য:
•এক সাইটের ফিচার উপরে উল্লেখিত সাইটগুলো থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। এখানে প্রোভাইডারকে একটি প্রজেক্টে প্রতি ঘন্টা কাজের জন্য অর্থ প্রদান করা হয়।
•ক্লায়েন্ট সাধারণত একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য (কয়েক সপ্তাহ বা কয়েক মাস এর জন্য) এক বা একাধিক প্রোভাইডারকে নিয়োগ দেয়। অনেকক্ষেত্রে প্রজেক্ট শেষ না হওয়া পর্যন্ত প্রতিদিন কাজ করতে হয়।
•কাজ করার মূহুর্তে প্রোভাইডারের ব্যয়কৃত সময় নির্ধারণ করার জন্য প্রোভাইডারের কম্পিউটারে একটি সফটওয়্যার চালু রাখতে হয়, যা একটি নির্দিষ্ট সময় পরপর তার ডেস্কটপের স্ক্রিনশট এবং অন্যান্য তথ্য ক্লায়েন্টের কাছে পাঠায়। ফলে ওই সময় সে কাজ করছেন কিনা ক্লায়েন্ট সহজেই যাচাই করতে পারে।
•এই সাইটে প্রতি কাজের জন্য ১০% অর্থ কমিশন হিসেবে প্রদান করতে হয়।
সুবিধাসমূহ:
•যেহেতু প্রতি ঘন্টা কাজের জন্য মূল্য পরিশোধ করা হয় তাই অন্য সাইটগুলোর তুলনায় এই সাইট থেকে অনেক বেশি পরিমাণে আয় করা সম্ভব।
•এখানে অনেক প্রজেক্ট পাওয়া যায় যাতে সম্পূর্ণ প্রজেক্টের জন্য মূল্য পরিশোধ করা হয়। ফলে যারা ঘন্টা ধরে কাজ করতে পছন্দ করে না তারাও এই সাইট থেকে কাজ করতে পারবে।
অসুবিধাসমূহ:
•একটি প্রজেক্টে কাজ করতে প্রতিদিন ফ্রিল্যান্সারকে দিনের একটা নির্দিষ্ট সময় অনলাইনে লগইন থেকে কাজ করতে হয়। ব্যাপারটা অনেকটা অফিসে বসে একটা নির্দিষ্ট সময় ধরে কাজ করার মত, যা অনেক ফ্রিল্যান্সারের কাছে পছন্দ নয়।
•কাজ করার সময় ওডেস্কের সফটওয়ার একটি নির্দিষ্ট সময় পর পর প্রোভাইডারের কম্পিউটারের ডেস্কটপের ছবি বায়ারের কাছে পাঠায় যা একজন ফ্রিল্যান্সারের ব্যক্তিগত স্বাধীনতা খর্ব করে।
অনলাইনে কাজের প্রকারভেদ
অনলাইনে প্রায় সকল ধরনের কাজ করা যায়। আপনি যে কাজে পারদর্শী তা দিয়েই ঘরে বসে আয় করতে পারেন। এজন্য আপনাকে যে কম্পিউটার সায়েন্সে স্নাতকধারী হতে হবে তা কিন্তু নয়। আর আপনি যদি মনে করেন কোন একটি নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে আপনি বিশেষ পারদর্শী নন তাহলে ডাটা এন্ট্রির মত কাজগুলো সহজেই করতে পারেন। ফ্রিল্যান্স মার্কেটপ্লেস সাইটগুলোতে তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর প্রায় সকল ধরনের কাজ পাওয়া যায়। প্রোগ্রামিং, ওয়েবসাইট তৈরি, গ্রাফিক্স ডিজাইন, মাল্টিমিডিয়া থেকে শুরু করে ডাটা এন্ট্রি, ডাটা প্রসেসিং, প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট অথবা কোন ওয়েবসাইটের জন্য আর্টিকেল লেখা - কি নেই সাইটগুলোতে। অনলাইনে কি কি ধরনের কাজ পাওয়া যায় তা জানতে নিচের তথ্যগুলো লক্ষ করুন। এখানে গেট-এ-ফ্রিল্যান্সার সাইটে এই মূহুর্তে (২০ নভেম্বর ২০০৮) যে ধরনের কাজ, যত সংখ্যায় পাওয়া যাচ্ছে তা উল্লেখ করা হল
অন্যদিকে আরেকটি ফ্রিল্যান্স মার্কেটপ্লেস সাইট www.GetACoder.com পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে এ পর্যন্ত যে সকল প্রজেক্ট সাবমিট করা হয়েছে তার মধ্যে প্রোগ্রামিং (৩৬.৯%) এবং ওয়েব ডেভেলপমেন্টের (২৬.৮%) কাজগুলোই সবচেয়ে বেশি। তার পরবর্তী স্থানে রয়েছে গ্রাফিক্স/মাল্টিমিডিয়া (১২.৪%) এবং ডাটাবেইজের (১২.৩%) কাজগুলো। নিচের চার্টের মাধ্যমে নভেম্বর ২০০৮ তারিখে ওই সাইটে প্রাপ্ত কাজের তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরা হল (বড় করে দেখতে ছবিটির উপর ক্লিক করুন) -
ফ্রিল্যান্সিং এ কয়েকটি গুরুত্ত্বপূর্ণ বিষয়
ফ্রিল্যান্স মার্কেটপ্লেস সাইটে কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আছে যা ভালভাবে না জানার কারণে অনেকে সফলভাবে ফ্রিল্যান্সিং শুরু করতে পারেন না। নিচে এরকম কয়েকটি বিষয় আলোকপাত করা হল:রেটিং (Rating) - একটি কাজ সম্পন্ন হবার পর ক্লায়েন্ট কাজের ফলাফলের উপর ভিত্তি করে প্রোভাইডারকে ১ থেকে ১০ এর মধ্যে রেটিং দেয়। এখানে সর্বোত্তকৃষ্ট রেটিং হচ্ছে ১০ এবং সর্বনিম্ন রেটিং হচ্ছে ১। নতুন কাজ পাবার ক্ষেত্রে এই রেটিং খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। তাই সবসময় ১০ রেটিং পাওয়ার জন্য প্রজেক্টের রিকোয়ারমেন্ট পরিপূর্ণভাবে এবং দক্ষতার সাথে সম্পন্ন করা উচিত।
রেংকিং (Ranking) - একটি ফ্রিল্যান্সিং সাইটে রেজিষ্ট্রেশনকৃত সকল প্রোভাইডারের মধ্যে একজন নির্দিষ্ট প্রোভাইডারের অবস্থান কত তা জানা যায় রেংকিং এর মাধ্যমে। সাধারণত একজন প্রোভাইডারের গড় রেটিং এবং সে কত বেশি ডলারের কাজ করেছে তার উপর ভিত্তি করে রেংকিং নির্ধারণ করা হয়। রেটিং এর মত রেংকিংও নতুন কাজ পাবার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। যার রেংকিং যত সামনের দিকে তার কাজ পাবার সম্ভাবনা অন্যদের চাইতে বেশি।
ডেডলাইন (Deadline) - প্রত্যেক প্রজেক্ট শেষ করার একটি নির্দিষ্ট সময়সীমা বা ডেডলাইন সময় থাকে। এই সময়ের পূর্বে অবশ্যই কাজ শেষ করতে হয়। কোন প্রোভাইডার যদি ডেডলাইনের পূর্বে কাজ শেষ করতে না পারে তাহলে বায়ার ইচ্ছে করলে তাকে কোন মূল্য পরিশোধ না করে সম্পন্ন কাজটি নিয়ে যেতে পারে। উপরন্তু ক্লায়েন্ট সেই প্রোভাইডারকে একটি নিম্নমানের রেটিং দিয়ে দিতে পারে। তাই কোন প্রজেক্টের ডেডলাইন সময় প্রয়োজনের তুলনায় কম হলে কাজ শুরুর পূর্বেই বায়ারকে অনুরোধ করে বাড়িয়ে নেয়া উচিত।
মেডিএশন/আর্বিট্রেশন (Mediation/Arbitration) - একটি প্রজেক্ট চলাকালীন সময় বায়ার এবং প্রোভাইডারের মধ্যে কোন সমস্যা হলে তা সমাধানের জন্য মেডিএশন এর ব্যবস্থা রয়েছে। এই পদ্ধতিতে সাইটের যথাযথ কতৃপক্ষ উভয় পক্ষের সাথে আলোচনা করে এবং সমাধানের কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়।
এসক্রো (Escrow) - কাজ শুরু করার পর ক্লায়েন্ট কাজের সম্পূর্ণ অর্থ ওই ফ্রিল্যান্সিং সাইটে জমা রাখে। এই জমা রাখাকে বলা হয় এসক্রো যা কাজ সম্পন্ন হবার পর কোডারের টাকা পাবার সম্ভাবনা নিশ্চিত করে। ক্লায়েন্ট টাকা এসক্রোতে জমা রাখা পূর্বে কাজ শুরু করা উচিত নয়।
অর্থ উত্তোলনের উপায়সমূহ
কাজ সম্পন্ন হবার পর প্রোভাইডারের পাওনা অর্থ ফ্রিল্যান্সিং সাইটের একাউন্টে জমা থাকে। মাসের শেষে বা মাসের মাঝামাঝি সময়ে সর্বমোট অর্থ বিভিন্ন উপায়ে দেশে নিয়ে আসা যায়। এখানে টাকা উত্তোলনের কয়েকটি কার্যকর পদ্ধতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হল:Snail Mail Check
এই পদ্ধতিতে খরচ তুলনামূলকভাবে কম কিন্তু এটি সময়সাপেক্ষ পদ্ধতি। মোট আয় যদি ১০০ ডলারের এর উপর হয় তাহলে চিঠির মাধ্যমে একটি চেক পাঠিয়ে দেয়া হয়। প্রতিবার টাকা উত্তোলনে খরচ পড়ে মাত্র ১০ ডলার। তবে চিঠি আসতে কয়েক সপ্তাহ সময় লেগে যেতে পারে। আর চেকটি আসবে ডলার-এ, তাই এটিকে টাকাতে রূপান্তর করতে হলে ব্যাংকের সাহায্য নিতে হবে।
Bank to Bank Wire Transfer
টাকা উত্তোলনের একটি নির্ভরযোগ্য ও নিরাপদ উপায় হচ্ছে ওয়্যার ট্রান্সফার। এই পদ্ধতিতে মাস শেষে ৩ থেকে ৫ দিনের মধ্যে সম্পূর্ণ টাকা সরাসরি প্রোভাইডারের ব্যাংক একাউন্টে এসে জমা হয়ে যায়। তবে এই পদ্ধতিতে চার্জ একটু বেশি - প্রতিবার টাকা উত্তোলনে ৪৫ থেকে ৫৫ ডলার খরচ পড়বে। এই পদ্ধতিতে টাকা উত্তোলন করতে হলে নিম্নে উল্লেখিত তথ্যগুলো ফ্রিল্যান্সিং সাইটে প্রদান করতে হবে:
•প্রোভাইডারের ব্যাংক একাউন্ট নাম্বার, ব্যাংক এর ঠিকানা এবং ব্যাংকের SWIFT Code
•ফ্রিল্যান্সিং সাইটি যে দেশে অবস্থিত সেই দেশের একটি ব্যাংকের নাম যা অর্থ প্রেরণের জন্য মধ্যবর্তী মাধ্যম হিসেবে কাজ করবে। এজন্য আপনি আপনার ব্যাংক এ গিয়ে জেনে নিতে পারেন তারা ওই দেশের কোন কোন ব্যাংক এর মাধ্যমে অর্থ আদান-প্রদান করে থাকে।
•এরপর মধ্যবর্তী ওই ব্যংক এর Routing নাম্বার সংগ্রহ করতে হবে যা ব্যাংকটির ওয়েবসাইট এ পাওয়া যেতে পারে। ব্যাংক এর সাইটে না পাওয়া গেলে Google এ সার্চ করে দেখতে পারেন অথবা আপনার ব্যাংক থেকেও সংগ্রহ করতে পারেন। যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে এই নাম্বারকে বলা হয় ABA Routing Number।
Payoneer Debit কার্ড
উপরের দুটি পদ্ধতি থেকে সবচাইতে দ্রুত পদ্ধতি হচ্ছে Payoneer Debit Card । সম্প্রতি প্রায় সকল ফ্রিল্যান্সিং সাইটগুলো এই MasterCard সার্ভিসটি চালু করেছে। এই পদ্ধতিতে মাস শেষে আপনি টাকা খুবই দ্রুত পৃথিবীর যেকোন স্থান থেকে ATM এর মাধ্যমে উত্তোলন করতে পারেন। এজন্য এককালীন খরচ পড়বে ২০ ডলার আর সাইটির মাসিক ব্যবস্থাপনা ফি ৩ ডলার। ATM থেকে প্রতিবার টাকা উত্তোলনের জন্য খরচ পড়বে ২.১৫ ডলার + উত্তোলনকৃত অর্থের ৩%। এই কার্ড দিয়ে টাকা উত্তোলনের পাশাপাশি অনলাইনে কেনাকাটাও করতে পারবেন। এমনকি এর মাধ্যমে বিদেশে অবস্থিত আপনার কোন আত্মীয় বা বন্ধুবান্ধব তাদের মাস্টারকার্ড বা ভিসা কার্ড থেকে আপনাকে টাকা পাঠাতে পারবে। পেওনার সাইট থেকে সরাসরি এই কার্ডের জন্য আবেদন করা যায় না। এটি পেতে হলে ফ্রিল্যান্সিং যে কোন একটি সাইট (রেন্ট-এ-কোডার, গেট-এ-ফ্রিল্যান্সার বা ওডেস্ক) থেকে আবেদন করলে ২০ থেকে ৩০ দিনের মধ্যে এই কার্ডটি হাতে পাওয়া যায়।
ফ্রিল্যান্সিং নিয়ে আরো তথ্য:
ফ্রিল্যান্স আউটসোর্সিং সম্পর্কে বিস্তারিত আরো জানতে "ফ্রিল্যান্সার হওয়ার গল্প" নামক একটি বাংলা ব্লগ সাইট ভিজিট করতে পারেন। এই সাইটে নিয়মিতভাবে ফ্রিল্যান্সিং নিয়ে বিভিন্ন আর্টিকেল লেখা হয়। পাশাপাশি ফ্রিল্যান্সিং সংক্রান্ত বিভিন্ন ধরনের খবরও এই সাইটে পাওয়া যায়। সাইটির ঠিকানা হচ্ছে - www.FreelancerStory.blogspot.com
আরেকটি হচ্ছে "ফ্রিল্যান্স ফেস্ট" নামে একটি অনলাইন ফোরাম। ফোরামটি গঠন এবং পরিচালনা করছেন আমাদের দেশী কয়েকজন সফল ফ্রিল্যান্সার। ফ্রিল্যান্স আউটসোর্সিং এ আগ্রহী যে কেউ এই ফোরামে রেজিষ্ট্রেশন করতে পারবেন এবং ফ্রিল্যান্সিং নিয়ে যেকোন ধরনের সমস্যা ও তার সমাধানের পথ নিয়ে আলোচনায় অংশগ্রহণ করতে পারবেন। ফোরামটির ঠিকানা হচ্ছে - www.FreelanceFest.com
পাশাপাশি আপনি ইচ্ছে করলে "বিডিওএসএন আউটসোর্সিং" নামক গুগল গ্রুপে যোগদান করতে পারেন। এই গ্রুপের মাধ্যমে আপনি ফ্রিল্যান্সারদের সাথে সরাসরি ইমেইলে যোগাযোগ করতে পারেন। গ্রুপটির ঠিকানা হচ্ছে - http://groups.google.com/group/bdosn_outsourcing
শেষকথা:
বর্তমান আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে ফ্রিল্যান্স আউটসোর্সিং হতে পারে অর্থনৈতিক মুক্তির উপায়। দেশের দক্ষ ও বেকার জনগোষ্ঠিকে জনশক্তিতে পরিণত করতে এটি হতে পারে একটি প্রধান নিয়ামক। তবে খেয়াল রাখতে হবে, প্রাথমিক অবস্থায় অনলাইনে কাজ পাওয়াটা সহজ নয়। প্রয়োজন ধৈর্য ও পরিশ্রম করার মানসিকতা। কারণ এখানে আপনাকে বিভিন্ন দেশের দক্ষ ফ্রিল্যান্সারদের সাথে প্রতিযোগীতা করে কাজ আনতে হবে। তাই ফ্রিল্যান্সিং যারা শুরু করতে চান তাদের হতে হবে আত্মবিশ্বাসী, প্রত্যয়ী ও সমসাময়িক তথ্য প্রযুক্তি সম্পর্কে অবগত। সর্বোপরি নিজ কর্মক্ষেত্রে দক্ষ।
No comments:
Post a Comment